২০২৫ সালের সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার অর্জন করেছেন হাঙ্গেরির মহাকাব্যিক ঔপন্যাসিক লাসজলো ক্রাস্‌নাহোরকাই। যিনি ভাষাকে পরিণত করেছেন ধ্বংসের অন্ধকারে আলোকিত এক শিল্পে, যাঁর বাক্য, দীর্ঘ ও মন্ত্রমুগ্ধকর, ছুঁয়ে যায় অস্তিত্বের গভীরতম শূন্যতাকে।

সুইডিশ একাডেমি তাঁকে সম্মানিত করেছে “তাঁর মন্ত্রমুগ্ধকর ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন সাহিত্যকর্মের জন্য, যা মহাপ্রলয়ের বিভীষিকাতেও শিল্পের শক্তিকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে।”
এই ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে ক্রাসনাহোরকাই যোগ দিলেন সেই বিরল কাতারে- যেখানে কাফকার নৈঃশব্দ্য, বেকেটের নিঃসঙ্গতা, এবং বার্নহার্ডের তীব্রতাও যেন নতুন করে অনুরণিত হয়। ২০০২ সালে ইমরে কের্তেসের পর এই পুরস্কার আবারও হাঙ্গেরির সাহিত্যভূমিকে ফিরিয়ে আনল বিশ্বের সাহিত্যমানচিত্রের কেন্দ্রে।
১৯৫৪ সালে হাঙ্গেরির গিউলা শহরে জন্ম নেওয়া লাসলো ক্রাসনাহোরকাই আশির দশকে আবির্ভূত হন, যখন সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন ক্ষয়িষ্ণু, আর ইউরোপ জেগে উঠছে উত্তর-আধুনিক বিভ্রমে। তাঁর প্রথম উপন্যাস Satantango (১৯৮৫) এক ধ্বংসপ্রায় গ্রামের কাহিনি। যেখানে মানুষ, মিথ্যা আর হতাশা মিশে গেছে এক নিঃশেষ অন্ধকারে। বিরামহীন বাক্য, অনুচ্ছেদহীন গদ্য, এক অদ্ভুত ছন্দে তিনি নির্মাণ করেন এক এমন জগৎ, যেখানে বাস্তবতা ভেঙে পড়ে বিভ্রমের ভেতর।

এই উপন্যাসই তাঁকে এনে দেয় “অবিচল দৃষ্টিসম্পন্ন এক বিপ্লবী লেখক”-এর খ্যাতি।
পরে খ্যাতনামা পরিচালক বেলা টার এই উপন্যাস অবলম্বনে নির্মাণ করেন সাত ঘণ্টাব্যাপী চলচ্চিত্র Satantango, যা হয়ে ওঠে ইউরোপীয় সিনেমার এক কিংবদন্তি সৃষ্টি। একটি অসাধারণ শৈল্পিক সৃষ্টি। লেখক ও পরিচালক মিলে ভেঙে দেন সাহিত্য ও চলচ্চিত্রের সীমারেখা বিশেষত Werckmeister Harmonies-এ, যা The Melancholy of Resistance-এর রূপান্তর।
ক্রাসনাহোরকাইয়ের সাহিত্য এক ভাঙা সভ্যতার দলিল। তাঁর জগতে গ্রাম ধসে পড়ে, নৈতিকতা বিলীন হয়, মানুষ হারিয়ে ফেলে দিকনির্দেশ; তবুও সেই ধ্বংসের ভিতরেই ঝলসে ওঠে এক পরম দীপ্তি যা শিল্পের, চিন্তার, আর মানবতার।
The Melancholy of Resistance (১৯৮৯)-এ এক রহস্যময় সার্কাস এসে বিশৃঙ্খলা ছড়ায় পচনধরা শহরে; War and War (১৯৯৯)-এ এক নিঃসঙ্গ আর্কাইভিস্ট মানবতার শেষ মুহূর্তে এক পাণ্ডুলিপি বাঁচাতে বেরিয়ে পড়ে এক অযৌক্তিক অভিযানে; আর Baron Wenckheim’s Homecoming (২০১৬)-এ স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ধারণাই পরিণত হয় এক অস্তিত্ববাদী প্রহসনে যেখানে বাড়ি ফেরা মানেই নিজেকে হারিয়ে ফেলা। তাঁর গদ্য যেন এক দীর্ঘ, শ্বাসরুদ্ধকর সঙ্গীত, একবার পড়া শুরু করলে, পাঠক ডুবে যায় এক অন্তহীন নদীতে, যেখানে সময় থেমে থাকে, কেবল শব্দ বয়ে চলে। ক্রাসনাহোরকাইয়ের লেখার প্রধান চরিত্র তাঁর ভাষা। তাঁর বাক্যরীতি যেন ধ্রুপদী সংগীতের মতো; প্রতিটি শব্দ পরেরটির দিকে গড়িয়ে যায় অনিবার্যতার ছন্দে। একটি বাক্য বিস্তৃত হতে পারে পৃষ্ঠা জুড়ে, কিন্তু সেই প্রবাহে হারিয়ে যায় না অর্থ বরং তা হয়ে ওঠে মনুষ্যচেতনার এক স্রোতস্বিনী।

তাঁকে প্রায়ই কাফকা, থমাস বার্নহার্ড ও স্যামুয়েল বেকেট-এর সঙ্গে তুলনা করা হয়,
কিন্তু ক্রাসনাহোরকাই আসলে একক এক সত্তা যার গদ্যে হতাশা ও পরমতার মিশ্রণে গঠিত হয় এক নতুন নন্দনচেতনা। সুইডিশ একাডেমি যথার্থই বলেছে, তিনি শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখেন “সান্ত্বনা নয়, মুখোমুখি হওয়ার সাহস” দিয়ে। তাঁর সাহিত্য অন্ধকার থেকে পলায়ন নয়;
বরং সেই অন্ধকারে প্রবেশ করে মানবতার ক্ষীণ আলোকে জাগিয়ে তোলা।
যদিও ক্রাসনাহোরকাইয়ের মাটি হাঙ্গেরিতে, তাঁর কল্পনা ছুঁয়ে যায় পূর্ব ও পশ্চিমের সীমান্ত।
চীন ও জাপানে তাঁর দীর্ঘ ভ্রমণ তাঁকে শিখিয়েছে নীরবতার শিল্প যা তাঁর পরবর্তী রচনায় ফুটে উঠেছে আধ্যাত্মিকতা, নিঃসঙ্গতা ও সভ্যতার ক্লান্ত ভারে।
অটিলি মুলজেট ও জর্জ সির্টেস-এর অসাধারণ অনুবাদের মাধ্যমে তাঁর সাহিত্য পৌঁছেছে বৈশ্বিক পাঠকসমাজে।
২০১৫ সালে ম্যান বুকার ইন্টারন্যাশনাল পুরস্কার তাঁর আজকের নোবেল প্রাপ্তির এক নীরব পূর্বাভাস ছিল যেন বিশ্ব আগেই অনুভব করেছিল, এই একাকী সাধক একদিন পৃথিবীর সাহিত্যকে নতুন সংজ্ঞা দেবেন।

ক্রাসনাহোরকাই যে পৃথিবী নির্মাণ করেন, তা আসলে আমাদেরই প্রতিচ্ছবি ভাঙা, বিভ্রান্ত, উদ্বিগ্ন, অথচ এখনও আশায় জেগে থাকা। তাঁর সাহিত্য কোনো পলায়ন নয়, এটি এক ধৈর্যের সাধনা, যেখানে শিল্প অর্থহীনতার মাঝেও মানবিকতার স্ফুলিঙ্গ ধরে রাখে।
এই দ্রুতগতির, মনোযোগহীন যুগে তাঁর গদ্য যেন এক প্রতিরোধ অমনোযোগের বিরুদ্ধে, হতাশার বিরুদ্ধে, বিস্মৃতির বিরুদ্ধে। তাঁকে সম্মান জানিয়ে নোবেল কমিটি যেন এক গভীর বার্তা দিয়েছে যে- গভীর, কঠিন, অথচ সত্যিকারের শিল্প এখনো টিকে আছে,
যত দ্রুতই ঘুরুক আমাদের এই পৃথিবী।

তথ্যসূত্র
Reuters (৯ অক্টোবর ২০২৫): “Hungarian writer László Krasznahorkai wins Nobel Prize in Literature.”
The Guardian (৯ অক্টোবর ২০২৫): “László Krasznahorkai: Master of the Apocalypse wins the Nobel.”
AP News (২০২৫): “Hungarian visionary writer wins Literature Nobel.”
NobelPrize.org: Official Nobel citation and biography, 2025.

ফারুক আহমেদ রনি
সম্পাদক, শিকড়

Leave a comment

Trending