ফারুক আহমেদ রনি
“একদা দালান ভাঙে, দেহ ভাঙে, রাষ্ট্র ভাঙে,
বিষদাঁত তাও ভেঙে যায়
মানুষ, যে মানুষ এতটা আপনার কাছে বাসা নিয়েছিল
সেই মানুষের কাছে আপনার মুখের ছবিটি একদিন নিঃশব্দে মিলায়।”
সৈয়দ শামসুল হক একটি নাম, একটি অনুভূতি, একটি অনুপ্রেরণা। সৈয়দ শামসুল হক নামটা শুনলেই মনের গভীরে এক অন্যরকম অনুভূতি কাজ করে। যার লেখা পড়ে পড়ে আমরা বড় হয়েছি। একদম ছোটবেলা থেকে তিনি মনের ভেতরে জায়গা করে নিয়েছেন। এতটাই কাছের, এতটাই যেন পরিচিত অদেখায়ও আমার আত্মার আত্মীয় হয়ে উঠেছি। প্রথম দেখা হয় লন্ডনের এক অনুষ্টানে ১৯৮৬ সালে তারপর আবার দেখা হয় ১৯৮৯ সালে। কবির শ্যালিকা ফাতেমা আপার বাসায়। ফাতেমা আপা আমার সহকর্মী, অবশ্য সহকর্মি বললে ভুল হবে। তিনি আমার বড় বোনের মত। আমার পাশের টেবিলে বসতেন তিনি। ফাতেমা আপার বাসায় আমাদের দেখা খুব আন্তরিকভাবে, একেবার ঘরোয়া পরিবেশে। তবে একজন অদেখা কবি বলতে আমাদের চোখের সামনে যে চিত্রটা ভেসে উঠে তিনি তেমন ছিলেন না। একদম অন্যরকম একজন মানুষ। জিন্স শার্ট আর ট্রাউজার পরে, যেন একদম তরুন যুবক। ভরাট কন্ঠ, মনে হয় তাঁর কন্ঠেও বিধাতা দিয়েছিলেন যাদুময়ী মুগ্ধতা। সেদিন দীর্ঘরাত পর্যন্ত আমাদের আড্ডা হয়। তাঁর জীবনের লেখালেখি, সিনেমা করার মানসে বাড়ি থেকে পালিয়ে বোম্বেতে যাওয়া তারপর ফিরে এসে স্বদেশে সিনেমার স্ক্রিপ্ট, পরিচালনা, গান ইত্যাদি নিয়ে একটা ব্যাস্ত সময় কাটানোর গল্পের পাশাপাশি, তাঁর শক্তিশালি সকল কাব্য রচনার অনেক ঘটনা, ভাবীকে (আনোয়ারা হক) নিয়ে অনেক গল্প। বিবিসিতে কাজ করার সময়কার গল্প যেন শেষ হয়না অনেক বিষয়। তারপর অসংখ্যবার দেখা হয়েছে, আমাদের আত্মিক সম্পর্কটাও সেভাবে গড়ে উঠে। সর্বশেষ দেখা, তখন তিনি অসুস্থ, ক্যান্সার আক্রান্ত এবং ঠিক একই সময়ে আমার মাও আক্রান্ত একই রুগে। তাঁকে দেখতে গিয়েছিলাম, দেখে খুব কষ্ট হচ্ছিলো। মাকে যেমন দেখেছি, ঠিক আমার প্রিয় এই মানুষটাকেও দেখে চোখের পানি লুকাতে পারিনি। মা ইহলোক ছেড়ে গেলেন চলে ২০১৬ সালের ১০ সেপেম্বর আর তিনি ২৭ সেপেম্বর।
সৈয়দ শামসুল হক ছিলেন এক জ্যোতির্ময় প্রতিকৃতি, যাঁর উপস্থিতি বাঙালির মননে এক গভীর বৈচিত্র্যময় দর্শন নিয়ে আসে। বাংলা সাহিত্যের এই পুরোধা ব্যক্তিত্ব যখন মনে উদয় হন, তখন তাঁর গভীরতা, সৃজনশীলতা এবং বহুমাত্রিক প্রতিভার সামনে মাথা নত হয়ে আসে। তিনি ছিলেন সাহিত্যের এমন এক শিল্পী, যিনি শব্দের কারুকাজে নির্মাণ করেছেন এক অনন্য জগৎ। তাঁর লেখনীতে একদিকে যেমন ফুটে উঠেছে মানব জীবনের সূক্ষ্ম আবেগ, তেমনি অন্যদিকে চিরন্তন সত্য, দেশপ্রেম এবং মানুষের সংগ্রামের অমোঘ চিত্র।
বাংলা সাহিত্যের এই মহীরুহ তাঁর কাব্যময় সৃষ্টির বিস্ময়ে আমাদের চেতনাকে জাগ্রত করেছেন। তিনি হৃদয়ের সমস্ত অনুভূতিকে উজাড় করে সাহিত্যের তেপান্তরে ছড়িয়ে দিয়েছেন এমন সব উপাদান, যা কখনো আমাদের মুগ্ধ করে, কখনো আন্দোলিত করে, আর কখনো জাগিয়ে তোলে চেতনার গভীরে লুকিয়ে থাকা শক্তিকে।
বাংলা সাহিত্যের কাব্য পরিচয় বহন করে তাঁর সার্বিক দর্শন থেকে, তিনি ছিলেন সব্যসাচী লেখক। তাঁর সৃষ্টিশীল জীবনের প্রতিটি অধ্যায় যেন একেকটি অমূল্য রত্ন। কবিতা, উপন্যাস, নাটক, গীতিকবিতা, সবক্ষেত্রেই তাঁর অসামান্য দক্ষতা তাঁকে বাংলা সাহিত্যের ভুবনে এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছে। তিনি ছিলেন এমন এক কাব্যশিল্পী, যিনি জীবনের প্রতিটি দিককে তাঁর সৃষ্টিতে তুলে এনেছেন। তাঁর কবিতায় আছে ব্যথা, প্রেম, প্রতিবাদ, এবং এক গভীর জীবনদর্শন। সাহিত্যের সর্বস্থানে তিনি এককভাবে ছিলেন কিংবদন্তী।
সৈয়দ শামসুল হক কেবল সাহিত্যিক নন, তিনি ছিলেন বাংলার গণমানুষের জীবন সংগ্রামের এক অদম্য সৈনিক। তাঁর রচনায় ফুটে উঠেছে বাঙালির গভীর বেদনা, উত্তরণ এবং অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রার কথা। জাগো বাহে, কোনঠে সবাই কেবল একটি কবিতা নয়, এটি যেন এক আদর্শিক ডাক, এক জাগরণের মন্ত্র। এটি কেবল সাহিত্যের শক্তি নয়, এটি বাঙালির রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবনের প্রেরণার এক প্রতীক। একান্তই বাঙালির হৃদয়ে গাঁথা বঙ্গবন্ধুর ‘জয় বাংলা’র মতই এটি আমাদের জাতীয় চেতনায় এক অবিস্মরণীয় স্থান দখল করে আছে এক অনির্বাণ আলোকধারা, যা বাঙালি জাতিকে দিয়েছে মুক্তির পথচিহ্ন। রংপুরের বিদ্রোহী সেই নূরুল উদ্দিনকে প্রকৃতপক্ষে বাঙ্গালিদের কাছে পরিচয় করে দিয়েছে সৈয়দ শামসুল হকের নূরলদীনের সারাজীবন। আমরা হয়তো নুরুল উদ্দিন নিয়ে এতটা জানার চেষ্টাও করতামনা, কিন্ত জাগো বাহে, কোনঠে সবাই– যেন সেই ইতিহাসকে আমাদের সামনে জাগ্রত করেছে।
তিনি তাঁর লেখার মাধ্যমে সাধারণ মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে তুলে ধরেছেন এবং তাদের সংগ্রামকে উদযাপন করেছেন। তাঁর রচনাগুলো জাতির জীবনের নানা বাঁক ও সংকটময় মুহূর্তের সাক্ষ্য বহন করে। আমাদের শিখিয়েছেন কেবল সাহিত্যসৃষ্টিতে নয়, কীভাবে সাহিত্য মানুষের জীবনের সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার হতে পারে। তাঁর লেখনীতে আমাদের দেশপ্রেম, সংস্কৃতি এবং মানবতার চিরন্তন সৌন্দর্য মূর্ত হয়ে ওঠে। সৈয়দ শামসুল হক তাই আমাদের কালের এক অভ্রান্ত পথিক, যিনি সাহিত্য দিয়ে আমাদের হৃদয়ে আলোর প্রদীপ জ্বেলে দিয়েছেন। তাঁর জাগো বাহে, কোনঠে সবাই যেন বাঙালি জাতির চেতনার সুরধ্বনি। এটি কেবল একটি কাব্য নয়, এটি একটি গণজাগরণের আহ্বান, যা বাঙালির ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ সময়ে আমাদের সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যেতে শক্তি যুগিয়ে আসছে। এই লাইনটি প্রমাণ করে, সাহিত্যের শক্তি শুধুই অনুভূতির উপস্থাপনা নয়; এটি এক শক্তিশালী সামাজিক হাতিয়ার, যা মানুষকে জাগিয়ে তোলে, উৎসাহিত করে এবং ঐক্যবদ্ধ করে। তাঁর কাব্যসৃষ্টির মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয়ে ওঠে মানুষের অন্তর্গত সংকট এবং মুক্তির আকাঙ্ক্ষা। তোমারে পাবো বলে বা পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় এমন কবিতা ও নাটক তাঁর অসাধারণ দক্ষতার প্রমাণ। পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়নাটকটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, যেখানে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের আবেগ ও সংগ্রাম জীবন্ত হয়ে উঠেছে। সৈয়দ শামসুল হকের নাটকে সংলাপের গভীরতা এবং চরিত্রগুলোর মানবিক দিকগুলো এমনভাবে প্রকাশ পায়, যা পাঠক বা দর্শকের মনে গভীর প্রভাব ফেলে।
সৈয়দ শামসুল হক এক বহুমুখী প্রতিভা। তিনি যখন গল্প লিখেছেন, তখন সেখানে জীবন ঘনিয়ে এসেছে। তাঁর উপন্যাসে উঠে এসেছে মানুষ এবং তার সামাজিক বাস্তবতার খণ্ডচিত্র। আবার যখন তিনি গীতিকবিতা লিখেছেন, তখন তা হয়ে উঠেছে হৃদয়গ্রাহী ও জনপ্রিয়। তাঁর রচিত গীতিগুলো যেমন এই দেশ তোমার আমার কিংবা হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস, সেগুলো কেবল জনপ্রিয় গান নয়, বরং একেকটি দার্শনিক চিন্তাধারা, যা আমাদের ভাবায়, আমাদের জীবন ও সমাজের অর্থ খুঁজতে বাধ্য করে।
সৈয়দ শামসুল হকের প্রভাব কেবল সাহিত্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। তিনি আমাদের জাতীয় চেতনা, আমাদের সংস্কৃতি এবং আমাদের জীবনধারাকে নতুন মাত্রা দিয়েছেন। সাহিত্যে তাঁর এই অবদান তাঁকে বাঙালির হৃদয়ে এক অবিচল অবস্থান দিয়েছে। তাঁর প্রতিটি লেখা একেকটি বটবৃক্ষের মতো, যা আমাদের সাহিত্যের ভুবনকে ছায়া দেয়, পুষ্টি দেয়, এবং আমাদের নতুন পথে এগিয়ে যাওয়ার সাহস জোগায়।
সৈয়দ শামসুল হক ছিলেন এমন এক মনীষী, যিনি কেবল লেখক নন, ছিলেন জাতির এক অগ্রদূত। তিনি আমাদের শিখিয়েছেন কীভাবে সাহিত্যের মাধ্যমে মানুষের মনের গভীরে প্রবেশ করা যায় এবং কীভাবে সেই সাহিত্যই হতে পারে একটি জাতির জন্য সর্বোত্তম হাতিয়ার। তাঁর মত কাব্যিক শক্তির অধিকারী একজন সাহিত্যিকের জন্ম একটি জাতির ভাগ্যে বিরল। তাই এই ক্ষণজন্মা কবি আমাদের জন্য শুধুই একজন সাহিত্যিক নন, তিনি আমাদের চেতনার একটি অংশ, আমাদের জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অধ্যায়।
তাঁর অসাধারণ সকল কাব্যগ্রন্থগুলোর মধ্যে নিষিদ্ধ লোবান, পরাণের গহীন ভিতর, বৈশাখে রচিত পংক্তিমালা, দ্বিতীয় জন্ম ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। নিষিদ্ধ লোবান কাব্যগ্রন্থটি সৈয়দ শামসুল হকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রচনা। এখানে তিনি যুদ্ধ, মানবতাবোধ এবং সমকালীন সামাজিক পরিস্থিতিকে তুলে ধরেছেন। কেবলমাত্র শব্দের খেলা নয়; এটি একটি কাব্যিক গণজাগরনের ডাক, অন্যায়, যুদ্ধ, অসামাজিক জীবনযাত্রার বিপক্ষে এবং মুক্তিযুদ্ধ চেতনায় এবং স্বাধীনতার সংগ্রামের গভীর চিত্র নিয়ে রচিত।পরাণের গহীন ভিতর একটি ভিন্ন এবং অত্যন্ত নান্দনিকভাবে উপস্থাপিত কাব্যগ্রন্থ যা বাংলা সাহিত্যের এক অবিস্মরণীয় রচনা।
সৈয়দ শামসুল হক আধুনিক বাংলা নাটকের অন্যতম পথিকৃৎ। তাঁর কিংববদন্তী নাটকগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য নাটকগুলো হল, নুরলদীনের সারা জীবন, পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়, এখানে এখন, ঈর্ষা, গণনায়ক ইত্যাদি । তাঁর নাটকগুলোতে বাঙালি জাতির সংগ্রাম, সংস্কৃতি এবং সমকালীন সমস্যা ফুটে উঠেছে। বিশেষ করে, নুরলদীনের সারা জীবন অন্যতম শ্রেষ্ঠ নাটক।
সৈয়দ শামসুল হকের কালোজয়ী উপন্যাসগুলো তাঁর ভাবনার গভীরতা এবং ভাষার নান্দনিকতায় সমৃদ্ধ। উল্লেখযোগ্য উপন্যাসগুলোর মধ্যে; খেলারাম খেলে যা, নীল দংশন, সীমানা ছাড়িয়ে, অনুপম দিন ইত্যাদি আমাদের বাঙালি জীবনে এক একটি বৈচিত্রময়, শক্তশালি রচনা। খেলারাম খেলে যা উপন্যাসটি একটি সাহসী এবং বিতর্কিত উপন্যাস। উপন্যাসটি মানুষের সম্পর্কের জটিলতা এবং জীবনের গভীর অন্তর্দ্বন্দ্ব নিয়ে লেখা। প্রেম, কামনা এবং আত্মার গভীর টানাপড়েন এখানে নিখুঁতভাবে চিত্রিত হয়েছে।
১৯৫৯ সালে তিনি মাটির পাহাড় চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য লিখেন। এরপর তিনি তোমার আমার, শীত বিকেল, কাঁচ কাটা হীরে, ক খ গ ঘ ঙ, বড় ভাল লোক ছিল, পুরস্কার-সহ আরও বেশ কিছু চলচ্চিত্রের কাহিনি, চিত্রনাট্য এবং সংলাপ রচনা করেন। বড় ভাল লোক ছিল ও পুরস্কার চলচ্চিত্রের জন্য তিনি শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যকার বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন।
সৈয়দ শামসুল হকের কবিতায় গভীর দার্শনিক ভাবনার প্রকাশ দেখা যায়। তাঁর কবিতা মানুষকে প্রশ্ন করতে শেখায় এবং জীবনের মূল সুর খুঁজে পেতে সাহায্য করে। প্রকৃতি এবং প্রেম তাঁর কবিতার অপরিহার্য উপাদান। প্রেম এখানে কেবল ব্যক্তিগত অনুভূতি নয়; এটি মানবজীবনের গভীরতম সত্যের অনুসন্ধান। সৈয়দ শামসুল হকের কাব্য ও বিশেষ রচনাগুলি বাংলা সাহিত্য ও সাহিত্যকর্মের গভীরতা, আধুনিকতা এবং বহুমাত্রিকতা বাংলা সাহিত্যে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। তিনি ছিলেন কবিতার ক্ষেত্রে একজন নিখুঁত শিল্পী, যার প্রতিটি শব্দ ও বাক্য মানবমনের গভীরে প্রবেশ করে। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে তাঁর রচনাগুলি স্বাধীনতার চেতনা এবং দেশপ্রেমকে কেন্দ্র করে রচিত হয়েছে।
সৈয়দ শামসুল হক তাঁর কাব্যিক ও রচনাগুলির মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যের এক অনন্য দিগন্ত উন্মোচন করেছেন। তাঁর লেখাগুলি ব্যক্তিগত এবং সামষ্টিক জীবনের গভীর উপলব্ধি প্রকাশ করে। তাঁর কাব্য এবং নাটক বাংলা সাহিত্যকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মর্যাদা এনে দিয়েছে।
সৈয়দ শামসুল হক ছিলেন এমন একজন বাঙালি সাহিত্যিক যিনি কাব্য, উপন্যাস, নাটক, ছোটগল্প এবং প্রবন্ধসহ সাহিত্যের প্রায় সব শাখায় অসামান্য অবদান রেখে গেছেন। তাঁর জীবন ছিল সাহিত্য সাধনার এক অনন্য দৃষ্টান্ত। তিনি বাংলা সাহিত্যের আধুনিক যুগের অন্যতম পথিকৃৎ হিসেবে বিবেচিত।
সৈয়দ শামসুল হক বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের জন্য অসংখ্য জনপ্রিয় চিত্রনাট্য এবং গান লিখেছেন। তাঁর গানগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য: হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস, জনম জনম তুমি আমার, এই পদ্মা এই মেঘনা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
সৈয়দ শামসুল হকের সাহিত্যজীবন ছিল দীর্ঘ এবং বহুমাত্রিক। তিনি সাহিত্যের প্রায় প্রতিটি শাখায় সফলতার স্বাক্ষর রেখেছেন। আধুনিকতা ও বাস্তবতা, দেশপ্রেম এবং মানবতার গভীর চেতনা, শব্দের মিতব্যয়িতা ও ছন্দময়তা সব মিলিয়ে তাঁর কাব্যভাবনা বাংলা সাহিত্যের নতুনধারার সৃষ্টে করেছে।
উল্লেখযোগ্য ছোটগল্পের ক্ষেত্রে তাঁর গল্পগুলোতে সম্পর্ক, সামাজিক দ্বন্দ্ব এবং জীবনবোধের সূক্ষ্মতা প্রকাশ পেয়েছে। সৈয়দ শামসুল হক সমকালীন বিষয় ও সাহিত্য নিয়ে বেশ কিছু প্রবন্ধ লিখেছেন। পাশাপাশি, তিনি শেক্সপিয়রের নাটকের অনুবাদও করেছেন, যা বাংলা সাহিত্যে এক উল্লেখযোগ্য অবদান।
সৈয়দ শামসুল হকের সাহিত্যকর্ম তাঁকে অসংখ্য পুরস্কার এনে দেয়। তাঁর জীবদ্দশায় তিনি বহু সম্মাননায় ভূষিত হন, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য: একুশে পদক, বাংলা একাডেমি পুরস্কার, স্বাধীনতা পুরস্কার, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (গীতিকার হিসেবে), বড় ভাল লোক ছিল ও পুরস্কার চলচ্চিত্রের জন্য তিনি শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যকার বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন।
সৈয়দ শামসুল হক ১৯৩৫ সালের ২৭ ডিসেম্বর কুড়িগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা সৈয়দ সিদ্দিক হুসাইন ছিলেন একজন স্কুল শিক্ষক এবং আইনজীবী। মাতা হালিমা খাতুন ছিলেন একজন গৃহিণী। তাঁর পরিবার ছিল প্রথাগত এবং শিক্ষার প্রতি গভীর আগ্রহী।
কুড়িগ্রামের নিসর্গময় পরিবেশ তাঁর সাহিত্যিক মানস গঠনে গভীর প্রভাব ফেলেছিল। ছোটবেলা থেকেই তাঁর মধ্যে সাহিত্য ও শিল্পকলার প্রতি আগ্রহ তৈরি হয়। ১৯৫০-এর দশকে তাঁর সাহিত্যকর্মের যাত্রা শুরু হয়। তাঁর প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয় ১৯৫১ সালে। এর পরপরই তিনি কবিতা, গল্প এবং প্রবন্ধ লিখতে শুরু করেন। একসময় ঢাকার সাহিত্যিক পরিমণ্ডলে তিনি পরিচিত মুখ হয়ে ওঠেন। ১৯৫৩ সালে কবিতা পত্রিকায় তাঁর কবিতা প্রকাশিত হলে তিনি ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেন।
১৯৬৪ সালে সৈয়দ শামসুল হক কথা সাহিত্যিক আনোয়ারা সৈয়দ হকের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। পরিবার ছিল তাঁর সাহিত্যিক জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ১৯৭১ সালের নভেম্বর মাসে তিনি বাংলাদেশ ত্যাগ করে লন্ডনে চলে আসেন এবং এখানে বিবিসি বাংলার খবর পাঠক হিসেবে চাকরি গ্রহণ করেন। উল্লেখযোগ্যভাবে, তিনি ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের খবরটি পাঠ করেছিলেন। পরবর্তীতে, ১৯৭২ থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত তিনি বিবিসি বাংলার প্রযোজক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তার দৃঢ় কণ্ঠ ও সাবলীল উচ্চারণের জন্য তিনি জনসাধারণের কাছে বিশেষ পরিচিতি লাভ করেন।
সৈয়দ শামসুল হকের জীবন ছিল সাহিত্য সাধনার এক উজ্জ্বল উদাহরণ। তাঁর বহুমুখী প্রতিভা বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে বিশ্বদরবারে এক নতুন উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছে। তাঁর জীবনের প্রতিটি অধ্যায় বাংলা সাহিত্যের অগ্রগতির ইতিহাসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তিনি তাঁর সৃষ্টিকর্মের মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যজগতে চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
সৈয়দ শামসুল হকের কর্মজীবন বাংলা সাহিত্যের এক উজ্জ্বল অধ্যায়। তাঁর সৃষ্টি ও সৃজনশীলতা আজও পাঠকদের অনুপ্রাণিত করে এবং বাংলা সাহিত্যে তিনি এক অবিস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব। ভাষার সারল্য ও গভীরতা, দার্শনিক চিন্তা ও মানবজীবনের জটিলতার অনুরণন, মুক্তিযুদ্ধ এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও তার ইতিহাসের প্রতি ছিলেন শ্রদ্ধাশীল। জাতি তাঁকে আজীবন মনে রাখবে। তিনি বেঁচে থাকবেন বাংলা সাহিত্যের কালোজয়ী কিংবদন্তী হয়ে। আজকে তাঁর জন্মদিনে আমরা স্মরণ করছি পরম শ্রদ্ধা ও ভালবাসায়। শুভ জন্মদিন, কবি।
সৈয়দ শামসুল হকের কিছু কবিতা
নূরলদীনের সারাজীবন
নিলক্ষা আকাশ নীল, হাজার হাজার তারা ঐ নীলে অগণিত আর
নিচে গ্রাম, গঞ্জ, হাট, জনপদ, লোকালয় আছে ঊনসত্তর হাজার।
ধবলদুধের মতো জ্যোৎস্না তার ঢালিতেছে চাঁদ-পূর্ণিমার।
নষ্ট খেত, নষ্ট মাঠ, নদী নষ্ট, বীজ নষ্ট, বড় নষ্ট যখন সংসার
তখন হঠাৎ কেন দেখা দেয় নিলক্ষার নীলে তীব্র শিস
দিয়ে এত বড় চাঁদ?
অতি অকস্মাৎ
স্তব্ধতার দেহ ছিঁড়ে কোন ধ্বনি? কোন শব্দ? কিসের প্রপাত?
গোল হয়ে আসুন সকলে,
ঘন হয়ে আসুন সকলে,
আমার মিনতি আজ স্থির হয়ে বসুন সকলে।
অতীত হঠাৎ হাতে হানা দেয় মরা আঙিনায়।
নূরলদীনের বাড়ি রংপুরে যে ছিল,
রংপুরে নূরলদীন একদিন ডাক দিয়েছিল
১১৮৯ সনে।
আবার বাংলার বুঝি পড়ে যায় মনে,
নূরলদীনের কথা মনে পড়ে যায়
যখন শকুন নেমে আসে এই সোনার বাংলায়;
নূরলদীনের কথা মনে পড়ে যায়
যখন আমার দেশ ছেয়ে যায় দালালেরই আলখাল্লায়;
নূরলদীনের কথা মনে পড়ে যায়
যখন আমার স্বপ্ন লুট হয়ে যায়;
নূরলদীনের কথা মনে পড়ে যায়
যখন আমার কণ্ঠ বাজেয়াপ্ত করে নিয়ে যায়;
নূরলদীনের কথা মনে পড়ে যায়
যখন আমারই দেশে এ আমার দেহ থেকে রক্ত ঝরে যায়
ইতিহাসে, প্রতিটি পৃষ্ঠায়।
আসুন, আসুন তবে, আজ এই প্রশস্ত প্রান্তরে;
যখন স্মৃতির দুধ জ্যোৎস্নার সাথে ঝরে পড়ে,
তখন কে থাকে ঘুমে? কে থাকে ভেতরে?
কে একা নিঃসঙ্গ বসে অশ্র“পাত করে?
সমস্ত নদীর অশ্র“ অবশেষে ব্রহ্মপুত্রে মেশে।
নূরলদীনের কথা যেন সারা দেশে
পাহাড়ী ঢলের মতো নেমে এসে সমস্ত ভাসায়,
অভাগা মানুষ যেন জেগে ওঠে আবার এ আশায়
যে, আবার নূরলদীন একদিন আসিবে বাংলায়,
আবার নূরলদীন একদিন কাল পূর্ণিমায়
দিবে ডাক, “জাগো, বাহে, কোনঠে সবায়?”
এখন মধ্যরাত
এখন মধ্যরাত।
তখন দুপুরে রাজপথে ছিলো মানুষের পদপাত।
মিছিলে মিছিলে টলমল ছিলো সারাদিন রাজধানী।
এখন কেবল জননকূল ছল বুড়িগঙ্গার পানি
শান্ত নীরব
নিদ্রিত সব।
ওই একজন জানালায় রাখে তার বিনিদ্র হাত
ছিলো একদিন তার
উজ্জ্বল দিন, ছিলো যৌবন ছিলো বহু চাইবার।
সারা রাত চষে ফিরেছে শহর খুঁজেছে সে ভালোবাসা।
পেতেছে সে হাত জীবনের কাছে ছিলো তারও প্রত্যাশা পাওয়া না পাওয়ার
প্রশ্নে হাওয়ার
বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে এখন সারারাত হাহাকার।
পথে ওড়ে ধুলো, ছাই ওড়ে শুধু পথে যে আগুন ছিলো
একদা সে জ্বেলে ছিলো।
হৃদয়ে এখন সৌধের ভাঙা টুকরো আছাড় খায়।
আলো নিভে যায়, নিভে যায় আলো একে একে জানালায়।
থেমে যায় গান
তারপরও প্রাণ
বাঁশিটির মতো বেজে চলে যেন সবই আছে সবই ছিলো।
পরানের গহীর ভিতর-১
জামার ভিতর থিকা যাদুমন্ত্রে বারায় ডাহুক,
চুলের ভিতর থিকা আকবর বাদশার মোহর,
মানুষ বেকুব চুপ,হাটবারে সকলে দেখুক
কেমন মোচড় দিয়া টাকা নিয়া যায় বাজিকর ৷
চক্ষের ভিতর থিকা সোহাগের পাখিরে উড়াও,
বুকের ভিতর থিকা পিরীতের পূর্ণিমার চান,
নিজেই তাজ্জব তুমি – একদিকে যাইবার চাও
অথচ আরেক দিকে খুব জোরে দেয় কেউ টান৷
সে তোমার পাওনার এতটুকু পরোয়া করে না,
খেলা যে দেখায় তার দ্যাখানের ইচ্ছায় দেখায়,
ডাহুক উড়ায়া দিয়া তারপর আবার ধরে না,
সোনার মোহর তার পড়া থাকে পথের ধূলায় ৷
এ বড় দারুণ বাজি, তারে কই বড় বাজিকর
যে তার রুমাল নাড়ে পরানের গহীন ভিতর ৷
একুশের কবিতা
সভ্যতার মণিবন্ধে সময়ের ঘড়ি
শিশুর জন্ম থেকে জরাদেহ ক্ষীণশ্বাস মানবের অবলুপ্তির সীমারেখায়
বলে গেল সেই কথা। সেই কথা বলে গেল অনর্গল–
তপ্তশ্বাস হাহুতাশ পাতাঝরা বিদীর্ণ বৈশাখীর জ্বালাকর দিগন্তে
আষাঢ়ের পুঞ্জীভূত কালো মেঘ আসবেই ঠিক।
সাগরের লোনাজলে স্নিগ্ধ মাটীর দ্বীপ
শ্যামলী স্বপ্নের গান বুকে পুষে
নবীন সূর্য্যেরে তার দৃঢ় অঙ্গীকার জানাবেই।
সংখ্যাহীন প্রতিবাদ ঢেউয়েরা আসুক, তুমি স্থির থেকো।
প্রাকৃতিক ঝঞ্ঝাবাত অবহেলা করি
সঞ্চয় করে যাও মুঠো মুঠো গৈরিক মাটী:
সবুজ গন্ধবাহী সোনালী সূর্য্যের দিশা
অকস্মাৎ উদ্ভাসিত কোরে দেবে তোমার চলার পথ।
সভ্যতার মণিবন্ধে সময়ের ঘড়ি
শিশুর জন্ম থেকে জরাদেহ ক্ষীণশ্বাস মানবের অবলুপ্তির সীমারেখায়
বলে গেল সেই কথা। সেই কথা বলে গেল অনর্গল–
পৃথিবীর জিজীবিষু আত্মার আছে। ঘনীভূত জনতার হৃদয়ে হৃদয়ে
উজ্জ্বল শিখা সেই অমর সংবাদে ঢেউ তুলে দিয়ে গেল।
এখন দূরে ডাকছে কেউ
তোমার যদি ঘুম পেয়েছে, ঘুমোতে যাও তুমি-
আমার নেই বিছানা, নেই ঘর ।
তারার নিচে এখন চিৎ আমার জন্মভূমি-
চতুর্দিকে ক্রন্দনের স্বর ।
এখন চাঁদ অন্নহীনের শূন্য কাঁসার থাল-
আছাড় দেয় আলো মাটির পর ।
আমার চোখে ঘুম আসে না, নদীর পানি লাল-
হাড়ের মতো শাদা নদীর চর ।
এখন দূরে ডাকছে কেউ, পাথার ভেঙে আসে-
ও কার এত ব্যাকুল কন্ঠস্বর?
আগুন আছে অপেক্ষায় নদীর উৎসমূলে-
আমাকে দিতে হবে যে উত্তর!
বলেছি তাকে, নিভৃত নীল পদ্ম
আমার সাথে কথা বলো তুমি নদীর মতো, আমার শরীরে
গাছের মতো বড় হও তুমি, আমার আঙুলে তুমি হাত রাখো
বাতাসের মতো, আমার হৃদয়ে তুমি জলপান করতে আসো
বাঘিনীর মতো, আমার চিন্তায় তুমি উড়ন্ত রূপালী হও
বিমানের মতো, আমার স্বপ্নের মধ্যে সুগন্ধ খাদ্যের মতো
বিস্তৃত হও, আমার দুঃখের স্রোতে ভাসাে তুমি নৌকোর
মতো, আমার সুখের নীলে জ্বলো তুমি সূর্যের মতো, আমার
বিশাল ক্ষতে সাহসী মাংসের মতো কোষে কোষে গড়ে ওঠো
তুমি, আমার পরাজয়ে উত্তোলিত হও তুমি ছিন্ন পতাকার
মতো, আমার মৃত্যুতে তুমি শোকের পেরেক হয়ে বিদ্ধ হও
যিসাসের দেহে, আমার জন্মের দিনে বিপুল বিভায় তুমি
ফেটে পড়ো সৌর-মহামন্ডলের মতো ।
দরজা খুলে দিলেই দেখবে
চাঁদ উঠেছে ফুল ফুটেছে কোন ক্যাসেটে গান
মধ্যরাতের মাতাল মাস্তান
দরজা ধরে দিচ্ছে ভীষণ টান ;
আমার এখন ভেতরটাতে তিনটে পোকার বাসা–
প্রথম দু’টো নাই শুনলে, শেষটা ভালোবাসা ;
ভালোবাসাই প্রথম সাঁকো, দ্বিতীয় সাঁকো, তৃতীয় চতুর্থ —
দীর্ঘজীবন আসলে তো একটিই মুহূর্ত ;
প্রথম দু’টো তোমার চোখ এবং তোমার মন ;
দরজা খুলে দিলেই দেখবে চৌকাঠে চরণ ।
তুমিই শুধু তুমি
তোমার দেহে লতিয়ে ওঠা ঘন সবুজ শাড়ি।
কপালে ওই টকটকে লাল টিপ।
আমি কি আর তোমাকে ছেড়ে
কোথাও যেতে পারি?
তুমি আমার পতাকা, আমার কৃষির বদ্বীপ।
করতলের স্বপ্ন-আমন ধানের গন্ধ তুমি
তুমি আমার চিত্রকলার তুলি।
পদ্য লেখার ছন্দ তুমি−সকল শব্দভুমি।
সন্তানের মুখে প্রথম বুলি।
বুকে তোমার দুধের নদী সংখ্যা তেরো শত।
পাহাড় থেকে সমতলে যে নামি−
নতুন চরের মতো তোমার চিবুক জাগ্রত−
তুমি আমার, প্রেমে তোমার আমি।
এমন তুমি রেখেছ ঘিরে−এমন করে সব−
যেদিকে যাই−তুমিই শুধু−তুমি!
অন্ধকারেও নিঃশ্বাসে পাই তোমার অনুভব,
ভোরের প্রথম আলোতেও তো তুমি!
কিছু শব্দ উড়ে যায়
কিছু শব্দ উড়ে যায়, কিছু শব্দ ডানা মুড়ে থাকে,
তরল পারার মতো কিছু শব্দ গলে পড়ে যায়।
এমন সে কোন শব্দ নক্ষত্রের মতো ফুটে থাকে
তুমি কি দেখেছো তাকে হৃদয়েশ্বরের আয়নায়?
দ্যাখোনি যখন কালো অন্ধকার উঠে আসে গ্রাসে।
যখন সৌজন্য যায় কবরে মাটি কল্পতায়,
যখন স্তব্ধতা গিলে খেতে থাকে কামুকেরা ত্রাসে,
তখন তাকিয়ে দেখো শুদ্ধতার গভীর ব্যাথায়
আমার ঠোঁটের থেকে একটি যে শব্দ একদিন
ফুটেছিলো এই ঠোঁটে তোমারই যে দেহস্পর্শ তাপে,
আজ সেই শব্দ দ্যাখো পৃথিবীর বুকে অন্তরীণ_
তবু তারই উচ্চারণে বৃক্ষপাতা বারবার কাঁপে।
পড়ে নিও তুমি তাকে, দেখে নিও আকাশে নয়তো
সেই শব্দ ‘ভালোবাসি’ নক্ষত্রের মতোই হয়তো।
আমার পরিচয়
আমি জন্মেছি বাংলায়
আমি বাংলায় কথা বলি।
আমি বাংলার আলপথ দিয়ে, হাজার বছর চলি।
চলি পলিমাটি কোমলে আমার চলার চিহ্ন ফেলে।
তেরশত নদী শুধায় আমাকে, কোথা থেকে তুমি এলে ?
আমি তো এসেছি চর্যাপদের অক্ষরগুলো থেকে
আমি তো এসেছি সওদাগরের ডিঙার বহর থেকে।
আমি তো এসেছি কৈবর্তের বিদ্রোহী গ্রাম থেকে
আমি তো এসেছি পালযুগ নামে চিত্রকলার থেকে।
এসেছি বাঙালি পাহাড়পুরের বৌদ্ধবিহার থেকে
এসেছি বাঙালি জোড়বাংলার মন্দির বেদি থেকে।
এসেছি বাঙালি বরেন্দ্রভূমে সোনা মসজিদ থেকে
এসেছি বাঙালি আউল-বাউল মাটির দেউল থেকে।
আমি তো এসেছি সার্বভৌম বারোভূঁইয়ার থেকে
আমি তো এসেছি ‘কমলার দীঘি’ ‘মহুয়ার পালা’ থেকে।
আমি তো এসেছি তিতুমীর আর হাজী শরীয়ত থেকে
আমি তো এসেছি গীতাঞ্জলি ও অগ্নিবীণার থেকে।
এসেছি বাঙালি ক্ষুদিরাম আর সূর্যসেনের থেকে
এসেছি বাঙালি জয়নুল আর অবন ঠাকুর থেকে।
এসেছি বাঙালি রাষ্ট্রভাষার লাল রাজপথ থেকে
এসেছি বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর থেকে।
আমি যে এসেছি জয়বাংলার বজ্রকণ্ঠ থেকে
আমি যে এসেছি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ থেকে।
এসেছি আমার পেছনে হাজার চরণচিহ্ন ফেলে
শুধাও আমাকে ‘এতদূর তুমি কোন প্রেরণায় এলে ?
তবে তুমি বুঝি বাঙালি জাতির ইতিহাস শোনো নাই-
‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।’
একসাথে আছি, একসাথে বাঁচি, আজো একসাথে থাকবোই
সব বিভেদের রেখা মুছে দিয়ে সাম্যের ছবি আঁকবোই।
পরিচয়ে আমি বাঙালি, আমার আছে ইতিহাস গর্বের-
কখনোই ভয় করিনাকো আমি উদ্যত কোনো খড়গের।
শত্রুর সাথে লড়াই করেছি, স্বপ্নের সাথে বাস;
অস্ত্রেও শান দিয়েছি যেমন শস্য করেছি চাষ;
একই হাসিমুখে বাজায়েছি বাঁশি, গলায় পরেছি ফাঁস;
আপোষ করিনি কখনোই আমি- এই হ’লো ইতিহাস।
এই ইতিহাস ভুলে যাবো আজ, আমি কি তেমন সন্তান ?
যখন আমার জনকের নাম শেখ মুজিবুর রহমান;
তারই ইতিহাস প্রেরণায় আমি বাংলায় পথ চলি-
চোখে নীলাকাশ, বুকে বিশ্বাস পায়ে উর্বর পলি।
একেই বুঝি মানুষ বলে
নষ্ট জলে পা ধুয়েছো এখন উপায় কি?
আচ্ছাদিত বুকের বোঁটা চুমোয় কেটেছি।
কথার কোলে ইচ্ছেগুলো বাৎসায়নের রতি,
মানে এবং অন্য মানে দুটোই জেনেছি।
নষ্ট জলে ধুইয়ে দেবে কখন আমার গা,
তোমার দিকে হাঁটবে কখন আমার দুটো পা?
সেই দিকে মন পড়েই আছে, দিন তো হলো শেষ;
তোমার মধ্যে পবিত্রতার একটি মহাদেশ
এবং এক জলের ধারা দেখতে পেয়েছি-
একেই বুঝি মানুষ বলে, ভালোবেসেছি।





Leave a comment