ফারুক আহমেদ রনি

কবিতা কি?

একটি কবিতা এমন একটি লেখার অংশ যা ধারণা, আবেগ বা ভাগ করে নেওয়ার জন্য কল্পনাপ্রসূত শব্দ ব্যবহার করে পাঠকের সামনে একটি গল্প উপস্থানের মত। কবিতা হলো সাহিত্য রচনার একটি বিশেষ শৈলী যা ভাষার সৌন্দর্য, ছন্দ, এবং অনুভূতির মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। কবিতার মধ্যে গভীর চিন্তা ও অনুভূতি সংক্ষিপ্ত এবং চিত্রময়ভাবে উপস্থাপন করা হয়। এটি একটি শিল্পকর্ম, যা পাঠকদের মনের গভীরে পৌঁছে যায়।

কবিতার শব্দ বা বাক্যাংশ জোরে জোরে পড়লে একসঙ্গে ভালো লাগে, সবচেয়ে ভাললাগার বিষয় হলো শিশুদের জন্য লেখা কবিতা ছড়া যাতে ছন্দ আছে (ঠিক সঙ্গীতের মত) অথবা পুনরাবৃত্তি।

তবেএ কটি কবিতা মানে ছড়া নয়, ছন্দের আদল থাকতে পারে কিন্ত কবিতার গঠনটা তার নিজস্ব নিয়মে তৈরি হবে।

কবিতা লেখা হয়ে আসছে ৪০০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে বা তারও আগে থেকে তবে তার মুল রচনার কারন হচ্ছে শ্রোতাদের সামনে আবৃত্তি করার জন্য।

সেভাবেই ইতিহাসে প্রাচীন গ্রীসের কিছু কবিতা যে গুলো সঙ্গীত হিসাবে পরিবেশনের জন্য।

পার্সি বাইশে শেলি  তার    ডিফেন্স অফ পোয়েট্রি এবং অন্যান্য রচনা গ্রন্থে” বলেন-কবিতা পৃথিবীর লুকানো সৌন্দর্য থেকে পর্দা তুলে নেয়, এবং পরিচিত বস্তুগুলিকে এমন করে তোলে যেন তারা পরিচিত নয়।

বাংলা কবিতা আধুনিকায়নের পিছনে কাজ করেছে  ইংরেজি সাহিত্য। বিশেষ করে ইংরেজি কবিতা আমাদের বাংলা কাব্যায়নে বড় ধরনের একটা প্রভাব রয়েছে। আজকের ইংরেজি  সাহিত্যে ব হুল ব্যবরিত শব্দের সাথে জুড়ে দেয়া ইজমগুলো বাংলা সাহিত্যেও প্রভাব ফেলেছে সমানভাবে এবং তার কারন বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ট ক বিরা ছিলেন ইংরেজি সাহিত্যের সাথে সুপরিচিত।  যার দরন ইংরেজিতে রোমান্টিসিজম, ক্লাসিসিজম, ন্যাচারালিজম, রিয়ালিজম, স্যুরিয়ালিজম, স্ট্রাকচারালিজম, মডার্নিজম, পোস্ট-মডার্নিজম এবং ডি-কন্সট্রাকশান বাংলা কবিতাকে সমৃদ্ধ করেছে। 

বাংলা কবিতার বিবর্তনের সাথে সাথে আমরা বাংলা ছন্দরুপের বিষয়ে অনেক এগিয়ে এসেছি।

কবিতা কেন লিখি?

কবিতা লেখার উদ্দেশ্য বিভিন্ন হতে পারে, যেমন:

অনুভূতির প্রকাশ: কবিতা লিখে আমরা আমাদের অনুভূতি, ভাবনা এবং অভিজ্ঞতাকে সুন্দরভাবে প্রকাশ করতে পারি।

সৃষ্টিশীলতা: কবিতা লেখার মাধ্যমে সৃজনশীলতা এবং কল্পনাশক্তির বিকাশ ঘটে।

সামাজিক ও রাজনৈতিক বক্তব্য: কবিতা সমাজের বিভিন্ন সমস্যা বা রাজনৈতিক বিষয়বস্তু নিয়ে কথা বলতে পারে।

আধ্যাত্মিকতা: অনেক কবি তাদের আধ্যাত্মিক অনুসন্ধান ও ভাবনাগুলো কবিতায় তুলে ধরেন।

কবিতা লিখতে হলে আমাদের্ প্রাতিষ্টানিক শিক্ষ্যার প্রয়োজন আছে এমন চিন্তা করার কোন যৌক্তিক কারন নেই। স্বতস্ফূর্ত আত্মায় নিঙড়ানো ভাবনাকে শব্দের কারুকাজে এবং কবিতার কাঠামো মেনে যেমন; ছন্দ, মাত্রার অলংকারে কল্পচিত্রকে সৃজনশীলভাবে উপস্থাপনের মাধ্যমে একটি কবিতা তৈরি হতে পারে।

এবার কবিতাকে পরবর্তী স্তরে নিয়ে যেতে হলে তার জন্য অবশ্যই মোইলিক কিছু নির্দেশিকা মানতে হবে। তারপর উৎকৃষ্ট কবিতার জন্য আরেক ধাপ এগিয়ে যেতে হবে।  

পড়তে হবে অনেক কবিতা।ভাবনার ভেতর দিয়ে প্রবেশিত শব্দগুলো নিয়ে মেতে থাকতে হবে, প্রয়োজনে শব্দের বিকল্প শব্দ খুজতে হবে। কবিতা আবৃত্তি শোনা বা কবিতাকে পড়তে হবে এমন ভাবে যাতে কর্ণ স্পর্শ করে, ইন্দ্রিয় বিমোহিত আবহ তেরি করতে পারে। আস্তে আস্তে কবিতার অন্তর্নিহিত ভাবনায় শব্দবুননে সাহায্য করতে পারে অভিধান। ছড়া, হাইকু, টাঙ্কা বা লিমেরিকের মতো স্বল্পদেইঘ্য বা একটি ছোট কবিতা হতে পারে তার প্রারম্ভিক যাত্রা।

কবিতা লেখার জন্য কিছু সাধারণ নিয়ম বা উপাদান রয়েছে:

ছন্দ ও মাত্রা: কবিতায় সাধারণত ছন্দ ও মাত্রার একটি নির্দিষ্ট কৌশল থাকে। এটি কবিতাকে সুরেলা ও সংগীতময় করে তোলে।

চিত্রকল্প: ভালো কবিতায় চিত্রকল্প ব্যবহার করা হয়, যা পাঠকের মনে একটি ছবি বা দৃশ্য তুলে ধরে।

ভাষার নির্বাচিততা: শব্দ নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সংক্ষিপ্ত ও অর্থবহ শব্দ ব্যবহার করা উচিত।

থিম: কবিতার একটি মূল থিম বা বিষয়বস্তু থাকতে হবে, যা কবিতার কেন্দ্রে থাকবে।

আবেগ: কবিতায় আবেগের প্রকাশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি পাঠকদের সাথে একটি সংযোগ তৈরি করে।
এই নিয়মগুলো কঠোরভাবে মেনে চলা না হলেও, কবিতা লেখার সময় এগুলো মনে রাখতে হবে।
কবিতায় ছন্দ ও মাত্রা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এদের মাধ্যমে কবিতার সুর, গতি, এবং পাঠকপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়। আসুন এগুলোর উপর বিস্তারিত আলোচনা করি।

১. ছন্দ

ছন্দ পরিচিতি

ছন্দের কলাকৌশল হলো কাব্যে রসবোধ ও শ্রুতিমধুর করে সুশৃঙ্খল বিন্যস্ত করে, যেমন; বর্ণ বা অক্ষর, শব্দ, ধ্বনি, মাত্রা, তাল-লয় পরিমিত যতি, পর্ব ইত্যাদি, যাতে উচ্চারণে সাথে ছন্দের মোহময় বিষয়টি পরিস্পুটিত হয়। মুলত তিন প্রকার ছন্দ নিয়ে কবিতার কারুকাজ। আর এইতিন প্রকার ছন্দ হলো স্বরবৃত্ত ছন্দ, মাত্রাবৃত্ত ছন্দ ও অক্ষরবৃত্ত ছন্দ। এই ভিন্ন ছন্দের মাত্রা ভিন্ন সময়ে কবিতার কাঠামোর পরিপ্রেক্ষিতে আলাদা আলাদা মাত্রাভাবে মাত্রা গোনা হয়।  

তাহলে আমরা দেখি স্বরটা কি? স্বরটাকে আমরা অক্ষর, শব্দ বা ইংরেজিতে সিলেবলও  বলতে পারি। যার মূল কাজ হলো উচ্চারণের জায়গাটাকে নির্ধারণ করা হয়।

প্রাথমিক প্রর্যায়ে স্বর দুই প্রকারের-  বদ্ধস্বর ও  মুক্তস্বর। বিশেষ করে স্বর বা অক্ষরের শেষে ব্যঞ্জনধ্বনি ব্যবহৃত হলে তা হবে বদ্ধস্বর, যেমন আম/১, নাম /১,  টক /১ অর্থাৎ এক মাত্রা করে গোনা হয়। অক্ষরের শেষে স্বরধ্বনি থাকলে তা হবে মুক্তস্বর, যেমন আমি, নামা, টাকা আ/১/মি/১ = ২ অর্থাৎ দুই  মাত্রা করে গোনা হয়।

এবার আসা যাক ছন্দের বিষয়ে; ছন্দ ৩ ভাবে বিভক্ত, যা আগে বলা হয়েছে তার প্রথমটা হলো স্বরবৃত্ত ছন্দ।

ছন্দ হল কবিতার শব্দের সুরেলা বিন্যাস, যা সাধারণত নির্দিষ্ট নিয়ম ও নিয়মাবলী অনুসরণ করে তৈরি হয়। ছন্দের মাধ্যমে কবিতার একটি সংগীতময় গুণ যোগ হয়। বাংলায় কিছু সাধারণ ছন্দের ধরন হল:

মুক্ত ছন্দ: যেখানে নির্দিষ্ট মাত্রা বা ছন্দের প্রয়োজন হয় না। লেখক স্বাধীনভাবে লিখতে পারেন। উদাহরণ: জীবনানন্দ দাশের কবিতায় মুক্ত ছন্দের প্রয়োগ লক্ষ্য করা যায়।

সাম্যক ছন্দ: যেখানে নির্দিষ্ট সংখ্যা এবং সঠিক মাত্রায় শব্দ ব্যবহৃত হয়। উদাহরণ: পঞ্চম সঙ্গীতের কবিতায় ছন্দগুলি সুনির্দিষ্ট।

দুই এবং তিন মাত্রার ছন্দ: বাংলায় প্রায়শই দুটি মাত্রার (যেমন: দোহার) এবং তিনটি মাত্রার (যেমন: ত্রিপদী) ছন্দ ব্যবহার করা হয়।

ছন্দের প্রকারভেদ – সারাংশ
ছন্দ মূলত ৩ প্রকার। শুরুতেই এই ৩ প্রকার ছন্দের নাম ও মাত্রাসংখ্যা সারাংশ হিসাবে উল্লেখ করা হলো।
স্বরবৃত্ত ছন্দ এ ছন্দটি ছড়ায় খুব বেশি ব্যবহৃত হয় বলে এটাকে ছড়ার ছন্দও বলা হয়। এতে সবসময় ৪ মাত্রার মূল পর্ব থাকে। বদ্ধস্বর ও মুক্তস্বর উভয়েই ১ মাত্রা হিসাবে গোনা হয়।
স্বর বা অক্ষরের শেষে ব্যঞ্জনধ্বনি থাকলে তা বদ্ধস্বর, যেমন বন (বন্‌), মান (মান্‌), এবং অক্ষরের শেষে স্বরধ্বনি থাকলে তা মুক্তস্বর, যেমন বাধা= ব্+আ=বা, ধ্+আ=ধা; পড়ো=প্+অ=প, ড়্+ও=ড়ো
মাত্রাবৃত্ত ছন্দ মূল পর্ব ৪, ৫, ৬ বা ৭ মাত্রার হয়। এই ছন্দে বদ্ধস্বর ২ মাত্রা এবং মুক্তস্বর ১ মাত্রা হিসাবে গণনা করা হয়। অর্থাৎ, অক্ষরের শেষে স্বরধ্বনি থাকলে ১ মাত্রা, আর অক্ষরের শেষে ব্যঞ্জনধ্বনি থাকলে, এমনকি ‘য়’ থাকলেও, ২ মাত্রা ধরা হয়।
অক্ষরবৃত্ত ছন্দ মূল পর্ব ৮ বা ১০ মাত্রার হয়। মুক্তস্বর, অর্থাৎ, অক্ষরের শেষে স্বরধ্বনি থাকলে ১ মাত্রা ধরা হয়। অক্ষরের শেষে ব্যঞ্জন ধ্বনি আছে, এমন অক্ষর শব্দের শেষে থাকলে ২ মাত্রা, আর শব্দের শুরুতে বা মাঝে থাকলে ১ মাত্রা গোনা হয়। তবে দুই বর্ণ বিশিষ্ট কোনো শব্দ বদ্ধস্বর হলে তা দুই মাত্রা ধরা হবে, যেমন- নদ, বন, মন, তির, ধীর, ক্ষেত, চাষ, মাস, স্নান, স্থান।

সারাংশের সারাংশ
ক। স্বরবৃত্ত=মূল পর্ব ৪ মাত্রা।
খ। মাত্রাবৃত্ত=মূল পর্ব ৪, ৫, ৬ বা ৭ মাত্রা।
গ। অক্ষরবৃত্ত=মূল পর্ব ৮ বা ১০ মাত্রা।

২. মাত্রা

মাত্রা হল একটি শব্দের মধ্যে বর্ণমালা বা সিলেবলের সংখ্যা। কবিতায় মাত্রার নির্দিষ্ট প্রয়োগ থাকে। বাংলা কবিতায় সাধারণত দুটি মূল মাত্রার শ্রেণী আছে:

দীর্ঘ (লম্বা) মাত্রা: যা এক বা একাধিক দীর্ঘ স্বরবর্ণের মাধ্যমে তৈরি হয়। উদাহরণ: “মহাকাল”, “প্রকৃতি”।

ছোট (সংক্ষিপ্ত) মাত্রা: যা এক বা একাধিক স্বল্প স্বরবর্ণের মাধ্যমে তৈরি হয়। উদাহরণ: “বন”, “পথ”।

৩. ছন্দ ও মাত্রার সম্পর্ক

ছন্দ ও মাত্রা একে অপরের সাথে সম্পর্কিত। একটি কবিতায় যে ছন্দ ব্যবহৃত হচ্ছে, তার সাথে নির্দিষ্ট মাত্রার বিধানও থাকবে। উদাহরণস্বরূপ, একটি ত্রিপদী কবিতায় সাধারণত তিনটি মাত্রার একটি নির্দিষ্ট গঠন থাকবে।

৪. ছন্দ ও মাত্রার উদাহরণ

কবিতায় ছন্দ ও মাত্রার ব্যবহার:

যেমন, “আমার দেশ” কবিতায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সুরেলা ছন্দ এবং সঠিক মাত্রা অনুভূত হয়। এই কবিতায় প্রতিটি লাইন সুনির্দিষ্ট মাত্রায় লেখা হয়েছে, যা পাঠকের মনে একটি সংগীতময়তা সৃষ্টি করে।

ছন্দ ও মাত্রা কবিতাকে একটি সুরেলা ও সংগীতময় আকার দেয়, যা পাঠকের অনুভূতিকে গভীরভাবে স্পর্শ করে। কবিরা তাদের সৃষ্টি প্রক্রিয়ায় এদের সঠিকভাবে ব্যবহার করে একটি বিশাল কাব্যিক অভিজ্ঞতা তৈরি করেন। তাই কবিতা লেখার সময় ছন্দ ও মাত্রার গুরুত্ব উপলব্ধি করা অপরিহার্য।

মাত্রা
ছন্দের প্রকারভেদ বলতে গিয়ে মাত্রার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। স্বর সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা পাওয়া গেছে, এবার মাত্রা সম্পর্কে আলোকপাত করা যাক।
একটি অক্ষর উচ্চারণের জন্য যতটুকু সময়ের প্রয়োজন, তাকে মাত্রা বলে। “সোজা কথায় মাত্রা মানে পরিমাপক অর্থাৎ ইউনিট অফ মেজার। জল মাপি লিটারে, কাপড় মাপি মিটারে আর ছন্দ মাপি মাত্রায়। কবিতার এক-একটি পঙ্ক্তির মধ্যে যে ধ্বনিপ্রবাহ থাকে, এবং তাকে উচ্চারণ করার জন্য মোট যে সময় আমরা নিয়ে থাকি, সেই উচ্চারণকালের ক্ষুদ্রতম এক-একটা অংশই হলো মাত্রা। প্রবোধচন্দ্র সেন তারই নাম দিয়েছেন কলা। কলা মানে এখানে অংশ।” (সরদার ফারুক)

যখন একটি অক্ষরে একটিই বর্ণ থাকে, তখন সেটি ১ মাত্রা হবে। যেমন,‘কলম’ শব্দটিকে বিশ্লেষণ করলে দুটি অক্ষর ক, লম্ পাওয়া যায়। এতে,‘ক’ একাই একটি মাত্রা, এবং এটি মুক্তস্বর বা মুক্তাক্ষর।

যদি একাধিক বর্ণ মিলে একটি অক্ষর বুঝায়, তখন ঐ একাধিক বর্ণ মিলে এক বা দুই মাত্রা হবে, এবং তা এক, নাকি দুই মাত্রা হবে সেটা ছন্দের শ্রেণিবিভাগের উপর নির্ভর করবে। যেমন, ‘কলম’ শব্দের ‘লম্‌’- এটি বদ্ধস্বর হওয়ায় স্বরবৃত্তে এক মাত্রা, মাত্রাবৃত্ত ও অক্ষরবৃত্তে তা দুই মাত্রা। এখন, একটি বড় শব্দের ক্ষেত্রে বোঝার চেষ্টা করি। যেমন, প্রত্যুৎপন্নমতি = প্রত্, তুৎ, পন্, ন, ম, তি। এখানে, ন, ম, তি এই তিনটি মুক্তাক্ষর এবং প্রত্, তুৎ, পন্, এই তিনটি বদ্ধাক্ষর। এ শব্দটি স্বরবৃত্তে ৬ মাত্রা হবে, বিভাজিত প্রতিটি অক্ষর এখানে এক মাত্রা। মাত্রাবৃত্তে ৯ (ৎ-কে এক মাত্রা ধরে) বা ৮ মাত্রা (ৎ-কে বাদ দিয়ে)। অক্ষরবৃত্তেও ৬ মাত্রা হবে। অক্ষরবৃত্তে বদ্ধস্বর শব্দের শুরুতে বা মাঝখানে থাকলে ১ মাত্রা ধরা হয়, আর শব্দের শেষে থাকলে ২ মাত্রা ধরা হয়। এখানে প্রত, তুৎ, পন্‌ শব্দের শুরু বা মাঝখানে থাকায় এগুলো ১ মাত্রা হিসাবে গণ্য হবে।

অক্ষর, স্বর বা ধ্বনি
বাগ্‌যন্ত্রের স্বলতম প্রয়াসে বা একঝোঁকে শব্দের যতটুকু অংশ উচ্চারিত হয়, তাকে অক্ষর বা দল বা স্বর বা ধ্বনি বলে। অক্ষর ইংরেজি সিলেবল-এর মতো। Conception= Con+cep+tion. এই Conception শব্দটিতে আমরা ৩টি সিলেবল দেখতে পাচ্ছি। তদ্রূপ, ‘সংসপ্তক’ শব্দটি ভাঙলে সং+সপ্‌+তক=৩টি অক্ষর পাচ্ছি। এভাবে, ‘অঘটনঘটনপটিয়সী’ শব্দটিকে ভাঙলে আমরা পাই=অ+ঘ+টন+ঘ+টন+প+টি+য়+সী=৯টি অক্ষর।

সাধারণ ভাবে আমরা বুঝি, প্রতিটি বর্ণই একেকটি অক্ষর। কিন্তু, বাংলা ব্যকরণের ভাষায় তা প্রকৃতপক্ষে সঠিক নয়। আমরা জানি, মানুষ মনের ভাব প্রকাশের জন্য মুখ থেকে যে সকল শব্দ বা আওয়াজ বের করে তাই ধ্বনি। আবার, ধ্বনির লিখিত রূপই হলো বর্ণ। কিন্তু, মানুষ কোনো শব্দ উচ্চারণ করার সময়, একবারে যতগুলো কম সংখ্যক বর্ণ উচ্চারণ করে, তাদের একেকটিকে একেকটি অক্ষর বলে। যেমন- চললাম। এটিকে আমরা চল্‌+লাম, অর্থাৎ চল্‌ ও লাম্‌ এ ২টি ভাগে উচ্চারণ করে থাকি। এভাবে প্রতিটি শব্দই আমরা এমন ভাগ ভাগ করেই উচ্চারণ করি। আর এই প্রতিটি ভাগই হলো একেকটি অক্ষর বা স্বর। মাত্রা নিয়ে আলোচনার সময় বিষয়টি আরো পরিষ্কার হয়ে যাবে।

সাধারণত কোনো একটি শব্দের প্রতিটি অক্ষরকেই ১ মাত্রা বলে বিবেচনা করা যায়। যেমন, চল+লাম। এখানে চল্ একটা মাত্রা এবং লাম্’’ একটা মাত্রা। অক্ষর এবং মাত্রার মধ্যে পার্থক্য আছে। অক্ষরের ধারণা থেকেই মাত্রার উৎপত্তি। ছন্দের শ্রেণি মোতাবেক একটি অক্ষর কখনো ১ মাত্রা, কখনো-বা ২ মাত্রা বহন করে।
বাংলা অক্ষর, স্বর বা ধ্বনিকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়, যথাঃ

বদ্ধস্বর বা বদ্ধাক্ষর,
মুক্তস্বর বা মুক্তাক্ষর

বদ্ধস্বর

যে সব ধ্বনি উচ্চারণের সময় জিভ মুখের প্রবহমান বাতাসকে আটকে দেয় তাদের বদ্ধস্বর বা বদ্ধাক্ষর বলা হয়। অন্য কথায়, অক্ষরের শেষে যদি ব্যঞ্জনধ্বনি থাকে, তাকে বদ্ধস্বর বা বদ্ধাক্ষর বলা হয়। যেমন : সব (সব্‌), জিভ (জিভ্‌), নাক (নাক্), তিল (তিল্‌), সম্মান (সম্‌+মান্‌), বলতেন (বল্‌+তেন্‌), চাইতেন (চাই+তেন্‌), মন, বিল, দিন, ইত্যাদি।

সব, জিভ, নাক, তিল, মন, বিল, দিন শব্দগুলোতে ১টি করে বদ্ধস্বর; সম্মান, বলতেন, চাইতেন শব্দগুলোতে ২টি করে বদ্ধস্বর রয়েছে। খেয়াল করুন, এই বদ্ধস্বরগুলো ইংরেজি সিলেবল-এর (syllable) সাথে তুলনীয়।

মুক্তস্বর

যে সব ধ্বনি উচ্চারণের সময় মুখের প্রবহমান বাতাস জিভের কোনো বাধা ছাড়াই বাইরে বেরিয়ে আসতে পারে তাদের মুক্তস্বর বা মুক্তাক্ষর বলে। অর্থাৎ, অক্ষরের শেষে স্বরধ্বনি থাকলে তা মুক্তস্বর বা মুক্তাক্ষর হবে। যেমন: বাবা (বা+বা), হ্যাঁ, না, চিরজীবী (চি+র+জী+বী), কালি (কা+লি), আলোছায়া (আ+লো+ছা+য়া), এইখানে (এ+ই+খা+নে), ভিজায়ে (ভি+জা+য়ে), ভুখানাঙ্গা (ভু+খা+না+ঙ্গা), কইতরী (ক+ই+ত+রী), যাবতীয় (যা+ব+তী+য়), নি, যা, খা, নে, ইত্যাদি।

উপরের ‘বাবা’ শব্দটিতে বা+বা ২টি মুক্তস্বর রয়েছে। ‘চিরজীবী’ শব্দে চি+র+জী+বী ৪টি মুক্তস্বর, আলোছায়া, এইখানে, ভুখানাঙ্গা, কইতরী, যাবতীয় শব্দগুলোতে ৪টি করে এবং ভিজায়ে শব্দটিতে ভি+জা+য়ে ৩টি মুক্তস্বর রয়েছে।

একই শব্দে বদ্ধস্বর ও মুক্তস্বর। আমাদের (আ+মা+দের), দাদির (দা+দির), ডালিম (ডা+লিম), করিলাম (ক+রি+লাম), যাচ্ছিলেন (যাচ্‌+ছি+লেন), আরামকেদারা (আ+রাম+কে+দা+রা), বাহাদুর (বা+হা+দুর), সঙ্গোপন (সং+গো+পন), স্থাপন (স্থা+পন), সংস্থাপন (সং+স্থা+পন), আস্থাশীল (আস্‌+থা+শীল), নির্ভরযোগ্য (নির্‌+ভর্‌+যোগ্+গ)।

মুক্ত ছন্দ কি?

মুক্ত ছন্দ (Free Verse) হল কবিতার একটি ধরনের ছন্দ যা নির্দিষ্ট কোনো নিয়ম বা গঠন অনুসরণ করে না। এটি শব্দের বিন্যাস, ছন্দ, এবং উচ্চারণের মধ্যে একটি স্বাধীনতা প্রদান করে, যা কবির চিন্তা ও অনুভূতিকে আরো মুক্তভাবে প্রকাশ করতে সক্ষম করে।

নির্দিষ্ট ছন্দের অভাব: মুক্ত ছন্দে সাধারণত কোনো নির্দিষ্ট মাত্রা বা ছন্দের প্রথাগত নিয়ম থাকে না। কবি নিজের ইচ্ছেমত লাইন, শব্দ এবং গতি নির্বাচন করতে পারেন।

স্বাধীনতা: কবি শব্দ ও বাক্যের রচনায় পূর্ণ স্বাধীনতা পান। তাদের চিন্তা ও অনুভূতি যেভাবে প্রকাশ করতে চান, সেভাবেই তারা লিখতে পারেন।

প্রাকৃতিক গতি: মুক্ত ছন্দের কবিতাগুলি সাধারণত কথ্য ভাষার মতো প্রাকৃতিকভাবে প্রবাহিত হয়। এটি পাঠকের কাছে অধিকতর সহজ এবং সাবলীল মনে হয়।

ছবি ও চিত্রকল্প: মুক্ত ছন্দে চিত্রকল্পের ব্যবহার ব্যাপক। কবি কল্পনার মাধ্যমে ভিন্ন ভিন্ন চিত্র এবং দৃশ্য তুলে ধরতে পারেন।

আবেগের গভীরতা: মুক্ত ছন্দ কবিকে তার অনুভূতি এবং ভাবনাগুলোকে গভীরভাবে প্রকাশ করার সুযোগ দেয়। কবির মানসিক অবস্থার সাথে সঙ্গতি রেখে ভাষা এবং শব্দ ব্যবহার করা হয়।

বাংলা সাহিত্যে মুক্ত ছন্দের কিছু প্রখ্যাত উদাহরণ হল:

জীবনানন্দ দাশের কবিতা: যেমন “বনলতা সেন” যেখানে কবি তার অনুভূতিগুলোকে মুক্তভাবে প্রকাশ করেছেন। নজরুল ইসলামের কবিতা: যেমন “বিদ্রোহী” যেখানে কবির বিদ্রোহী ভাবনা এবং আবেগ মুক্ত ছন্দে ফুটে উঠেছে।

মুক্ত ছন্দের গুরুত্ব

মুক্ত ছন্দ কবিদের জন্য একটি নতুন সৃষ্টি প্রক্রিয়া উদ্ভাবন করেছে। এটি কবিদের চিন্তাভাবনা এবং সমাজের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করার একটি উপায় হিসাবে কাজ করে। মুক্ত ছন্দের মাধ্যমে কবি তাদের অনুভূতি ও অভিজ্ঞতাকে অত্যন্ত সৃজনশীলভাবে প্রকাশ করতে সক্ষম হন, যা তাদের কবিতাকে আরো জীবন্ত এবং গতিশীল করে তোলে। মোটকথা, মুক্ত ছন্দ কবিতা একটি আধুনিক এবং সৃজনশীল সাহিত্যকর্ম, যা ভাষার স্বাধীনতা ও অনন্যতা প্রদান করে, এবং পাঠকের মনে গভীর প্রভাব ফেলে।স্বরবৃত্ত ছন্দ কি?

স্বরবৃত্ত ছন্দ কি?

স্বরবৃত্ত ছন্দ (Anapestic Meter) হলো বাংলা কবিতার একটি বিশেষ ছন্দ, যা সাধারণত দুটি অশ্রুত (অথাৎ, ছোট) স্বরবর্ণের পর একটি দীর্ঘ স্বরবর্ণের সমন্বয়ে গঠিত হয়। এটি মূলত কবিতার মধ্যে একটি সুরেলা ও মিষ্টি গতি সৃষ্টি করে।

স্বরবৃত্ত ছন্দের বৈশিষ্ট্য

গঠন: স্বরবৃত্ত ছন্দে তিনটি সিলেবল থাকে, যার মধ্যে প্রথম দুটি ছোট (অর্থাৎ, অক্ষর বা স্বল্পমাত্রার) এবং তৃতীয়টি দীর্ঘ (অর্থাৎ, স্বরবর্ণ বা অধিক মাত্রার)।

উদাহরণ: “অযথা ঘুমাও তুমি।” এখানে “অযথা” (অ-য-থা) দুটি ছোট সিলেবল এবং “ঘুমাও” (ঘু-মাও) একটি দীর্ঘ সিলেবল।

ছন্দ ও সুর: এই ছন্দের ফলে কবিতার মধ্যে একটি সুরেলা ও সংগীতময়তা দেখা যায়। স্বরবৃত্ত ছন্দের কারণে কবিতার শব্দগুলো সহজে আবৃত্তি করা যায় এবং এটি শুনতে ভাল লাগে।

প্রয়োগ: বাংলা সাহিত্যে স্বরবৃত্ত ছন্দের প্রয়োগ অনেক কবির লেখায় দেখা যায়। এটি সাধারণত বিভিন্ন আবেগ এবং অনুভূতি প্রকাশের জন্য ব্যবহার করা হয়।

বৈচিত্র্য: কবিরা স্বরবৃত্ত ছন্দের মধ্যে বিভিন্ন মাত্রা এবং গতি প্রয়োগ করে কবিতাকে আরও প্রাণবন্ত এবং অর্থপূর্ণ করতে পারেন।

স্বরবৃত্ত ছন্দের গুরুত্ব

স্বরবৃত্ত ছন্দ কবিতার মধ্যে একটি আঙ্গিক ও সুরেলা রূপ প্রদান করে। এটি কবির চিন্তা এবং অনুভূতিকে মুক্তভাবে প্রকাশ করার সুযোগ দেয়, যা পাঠকের মনে একটি বিশেষ অনুভূতি তৈরি করে। স্বরবৃত্ত ছন্দের ব্যবহার কবিকে তার শিল্পীর রূপে নতুন মাত্রা দেয় এবং বাংলা সাহিত্যের সমৃদ্ধির অংশ হিসেবে কাজ করে।

মোটকথা, স্বরবৃত্ত ছন্দ বাংলা কবিতার একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং সৃজনশীল উপাদান, যা কবিদের অভিব্যক্তি এবং ভাষার সৌন্দর্যকে মূর্ত করে। স্বরবৃত্ত ছন্দে লেখা হয়েছে, যেখানে প্রতি লাইনে সাধারণত ৮টি মাত্রা থাকে (৪টি দীর্ঘ এবং ৪টি ছোট)। স্বরবৃত্ত ছন্দে একটি সুনির্দিষ্ট গতি এবং ছন্দ রয়েছে, যা কবিতাকে একটি সংগীতময়তা দেয়।

স্বরবৃত্ত ছন্দ (Sressed Metre বা Syllable Metre):

ছড়া লেখায় স্বরবৃত্ত ছন্দকেই  ব্যবহার করা হয় বলে ছড়াছন্দ হিসাবেও তার খ্যাতি  বা লৌকিক ছন্দও বলা হয়। বিশেষ করে ছড়া, পদ্য বা দলবৃত্ত, শ্বাসাঘাত প্রধান, স্বরাঘাত প্রধান হয়ে থেকে। ছড়া, গান, পদ্য দে ছন্দ, গানের ছন্দ স্বরবৃত্ত ছন্দ। স্বরবৃত্ত মানেই দ্রুত গতির ছন্দ। গানে সব সময় দ্রুতরয়টা ভালো লাগে না। স্বরবৃত্তের চারমাত্রার পূর্ণ পর্বের বাঁধন টা ভেঙে পাঁচ বা ছয় মাত্রার পর্ব
তবে প্রতিটি পর্বে বদ্ধস্বর ও  মুক্তস্বর  উভয় ক্ষেত্রে ১ মাত্রা করে হয়।

স্বরবৃত্ত ছন্দে  পংক্তি হিসাবে  চারটি পর্ব থাকে  তবে, দুই বা তিন মাত্রার পর্ব ও থাকতে পারে। যেমন- ৪ ৪ ৫ ৩
পক্ষীরাজের/ খেয়াল হল/ ঘাস খাবে ৪+৪+৩
স্বর্গে কোথায়/ ঘাস পাবে? ৪+৩
একদিন সে/ ইন্দ্র রাজার/ সুখের দেশ ৪+৪+৩
শূন্য করে/ নিরুদ্দেশ ৪+৩

অথবা
বৃষ্টি নামলো যখন আমি উঠোন-পানে একা- ৪/৪/৪/২
দৌড়ে গিয়ে/ ভেবেছিলাম/ তোমার পাবো/ দেখা। ৪/৪/৪/২

মাত্রাবৃত্ত ছন্দ কি?

মাত্রাবৃত্ত ছন্দ (Iambic Meter) হল বাংলা কবিতার একটি বিশেষ ছন্দ, যা প্রতি পদে একটি ছোট স্বরবর্ণের (ছোট মাত্রার) পর একটি দীর্ঘ স্বরবর্ণ (বড় মাত্রার) যুক্ত হয়ে গঠিত হয়। এটি বাংলা কবিতায় খুবই জনপ্রিয় এবং ঐতিহ্যগতভাবে ব্যবহার করা হয়।

মাত্রাবৃত্ত ছন্দের বৈশিষ্ট্য

গঠন: একটি মাত্রাবৃত্ত ছন্দের পদে দুটি সিলেবল থাকে। প্রথমটি ছোট (অর্থাৎ, একটি অশ্রুত স্বরবর্ণ) এবং দ্বিতীয়টি দীর্ঘ (অর্থাৎ, একটি শ্রুত স্বরবর্ণ)।

উদাহরণ: “কেমন আছো তুমি” – এখানে “কে-মন” (ছোট) এবং “আছো” (দীর্ঘ) একত্রিত হয়েছে।

ছন্দের প্যাটার্ন: প্রতিটি পদে একটি মাত্রাবৃত্ত (iamb) থাকে, যা সাধারণত একটি শক্তিশালী সুর তৈরি করে। এটি কবিতাকে একটি নিয়মিত ও সুরেলা গতি প্রদান করে।

সুরেলা গতি: মাত্রাবৃত্ত ছন্দের ফলে কবিতায় একটি সংগীতময়তা এবং সুরেলা গতি তৈরি হয়, যা কবিতার পাঠককে সহজেই আকৃষ্ট করে।

নির্দিষ্ট সংখ্যা: বাংলা কবিতায় মাত্রাবৃত্ত ছন্দের পদের সংখ্যা নির্দিষ্ট হতে পারে, কিন্তু সাধারণত এটি ২, ৪, ৬, ৮, বা ১০ পদে বিভক্ত হয়ে থাকে।

মাত্রাবৃত্ত ছন্দের গুরুত্ব

মাত্রাবৃত্ত ছন্দ বাংলা কবিতাকে একটি সুন্দর এবং সুরেলা গঠন দেয়। এটি কবির ভাবনা ও অনুভূতিকে প্রকাশের একটি শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে কাজ করে। কবিরা তাদের অনুভূতি এবং আবেগকে সুচারুরূপে ফুটিয়ে তুলতে এই ছন্দের সাহায্য নেন, যা পাঠকের মনে গভীর প্রভাব ফেলে।

মোটকথা, মাত্রাবৃত্ত ছন্দ বাংলা কবিতার একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যা কবির সৃজনশীলতাকে প্রকাশের জন্য একটি গঠনমূলক এবং সংগীতময় অবলম্বন। এছাড়া, কবিতার বিষয়বস্তু এবং অভিব্যক্তি পাঠকের মনে একটি বিশেষ অনুভূতি তৈরি করে, যা কবিতাকে আরো আকর্ষণীয় করে তোলে।

মাত্রাবৃত্ত ছন্দ

মাত্রাবৃত্ত ছন্দে বদ্ধাক্ষর দুইমাত্রা হিসাবে গোনা  হয়। মাত্রাবৃত্তে বদ্ধাক্ষর সর্বদাই বিশিষ্ট ভঙ্গিতে অর্থাৎ টেনে টেনে উচ্চারিত হয়। মাত্রাবৃত্ত ছন্দে অক্ষর ধ্বনি বিশেষ প্রাধান্য লাভ করে বলে তাকে ধ্বনি-প্রধান ছন্দ ও বলা হয়। মাত্রাবৃত্ত ছন্দে প্রতি পংক্তির পর্বসংখ্যা নির্দিষ্ট নয়। পংক্তিগুলি গুলো দুই, তিন, চার পর্বে বিভক্তি হয়। প্রতি পর্বের মাত্রাসংখ্যা সাধারণত চার, পাঁচ, ছয় হয়ে থাকে। শেষের পর্বীট বেশির ভাগ সময় অপূর্ণ থাকে। সে কারণে ছন্দের সৌকর্য বৃদ্ধি পায়। যেমন-

গগণে গরজে মেঘ ঘন বরষা ৮ ৫
কুলে একা বসে থাকি। নাহি ভরসা ৮ ৫
রাশি ভারা ভারা ভারা। ধনে কাটা হল সারা ৮ ৫
ভরা নদী ক্ষুর ধারা। খর পরসা ৮+৫
কাটিতে কাটিতে ধান। এল বরষা। ৮ ৫

আবার

৫ ৫ ৫ ২+০০০
নতুন – জাগা। কুঞ্জবনে। কুহরি উঠে। পিক ০০০
বসন্তের। চুম্বনেতে। বিবশ দশ। দিক ০০০

অক্ষরবৃত্ত ছন্দ কি?

অক্ষরবৃত্ত ছন্দ (Trochaic Meter) হলো বাংলা কবিতার একটি বিশেষ ছন্দ, যেখানে প্রতিটি পদে প্রথমে একটি দীর্ঘ স্বরবর্ণ (বড় মাত্রার) এবং পরে একটি ছোট স্বরবর্ণ (ছোট মাত্রার) থাকে। এটি সাধারণত একটির পর একটি শব্দের সাথে জড়িত থাকে এবং কবিতাকে একটি সুরেলা ও সংগীতময় গতি দেয়।

অক্ষরবৃত্ত ছন্দের বৈশিষ্ট্য

গঠন:

প্রতিটি পদে অক্ষরবৃত্ত ছন্দে একটি দীর্ঘ স্বরবর্ণ (যা মৌলিকভাবে শক্তিশালী) এবং একটি ছোট স্বরবর্ণ থাকে। এটি একটি সঙ্গীতময় গঠন তৈরি করে।

উদাহরণ: “গোফর-পিয়ন” (গো-ফর), “কেউটাসের” (কে-উ-টা)।

সুরেলা গতি: অক্ষরবৃত্ত ছন্দ কবিতার মধ্যে একটি সুরেলা গতি সৃষ্টি করে, যা শোনার জন্য সুন্দর এবং আবৃত্তির জন্য সুবিধাজনক।

পদভঙ্গি: সাধারণত এই ছন্দে প্রতি পদে দুটো সিলেবল থাকে, কিন্তু পদসংখ্যা নির্দিষ্ট হয় না। এটি কবির ইচ্ছা অনুযায়ী পরিবর্তিত হতে পারে।

অক্ষরবৃত্ত ছন্দের বৈশিষ্ট্য যেখানে প্রথম শব্দটি দীর্ঘ এবং দ্বিতীয়টি ছোট। এই ধরণের ছন্দ ব্যবহার করে কবিরা তাদের ভাবনা এবং অনুভূতিকে একটি সুরেলা ছন্দে প্রকাশ করতে সক্ষম হন। অক্ষরবৃত্ত ছন্দের মাধ্যমে কবিতার সুর ও আবেগকে তুলে ধরার এক বিশেষত্ব রয়েছে, যা পাঠকের মনে গভীর প্রভাব ফেলে।

অক্ষরবৃত্ত ছন্দ বাংলা কবিতার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ এবং এটি কবিতার গঠন ও পাঠকপ্রিয়তা বৃদ্ধিতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে।

অমৃতাক্ষর ছন্দ কি?

অমৃতাক্ষর ছন্দ কি হল একটি বিশেষ ধরনের ছন্দ যা বাংলা কবিতায় ব্যবহৃত হয়। এটি একটি নির্দিষ্ট ছন্দের রীতি অনুসরণ করে, যেখানে প্রতিটি পঙক্তিতে সাধারণত ৮টি মাত্রা থাকে। এই ছন্দটি সাধারণত কবিতায় একটি সংগীতময় গতি তৈরি করে এবং এর বিশেষত্ব হলো এর সুরেলা স্বরবৃত্ত।

অমৃতাক্ষর ছন্দের বৈশিষ্ট্য

মাত্রা: অমৃতাক্ষর ছন্দে প্রতি পঙক্তিতে ৮টি মাত্রা থাকে। সাধারণত, এই ৮টি মাত্রার মধ্যে ৪টি দীর্ঘ এবং ৪টি ছোট স্বরবর্ণ থাকতে পারে।
গতি: এই ছন্দে একটি সংগীতময় গতি এবং সুর থাকে, যা পাঠকদের মনে এক ধরনের মধুরতা সৃষ্টি করে।

প্রতিবর্তন: কবিতার মধ্যে শব্দ এবং ভাবের পুনরাবৃত্তি প্রায়ই দেখা যায়, যা পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণ করে।

অমৃতাক্ষর ছন্দ কবিতাকে একটি সুরেলা এবং সংগীতময় আকার দেয়, যা পাঠকদের জন্য একটি বিশেষ ধরনের অভিজ্ঞতা সৃষ্টি করে। এই ছন্দে লেখা কবিতা প্রায়শই গভীর অনুভূতি ও ভাবনার প্রকাশ করে, এবং পাঠকের মনকে স্পর্শ করে। কবিদের জন্য এটি একটি জনপ্রিয় এবং কার্যকরী ছন্দের রীতি।

ওপেন ভার্স

ওপেন ভার্স (Open Verse) বা মুক্ত ছন্দ হলো কবিতার একটি শৈলী যা নির্দিষ্ট ছন্দ বা গঠন অনুসরণ করে না। এর মাধ্যমে কবি তাদের চিন্তাভাবনা এবং অনুভূতিগুলোকে স্বাধীনভাবে প্রকাশ করতে পারেন। ওপেন ভার্স সাধারণত সুর ও ছন্দের প্রথাগত নিয়মের সীমাবদ্ধতা ছাড়িয়ে যায় এবং কবিদের কল্পনা এবং সৃজনশীলতার জন্য অধিক মুক্তি প্রদান করে।

ওপেন ভার্সের বৈশিষ্ট্য

  1. ির্দিষ্ট ছন্দের অভাব: ওপেন ভার্সে কোনো নির্দিষ্ট মাত্রা বা ছন্দের নিয়ম নেই। কবি ইচ্ছেমত শব্দ এবং বাক্য ব্যবহার করতে পারেন।
  2. স্বাধীনতা: কবিরা তাদের চিন্তা এবং অনুভূতির প্রকাশে সম্পূর্ণ স্বাধীন। তারা যে কোনো কাঠামো বা ফর্ম ব্যবহার করতে পারেন।
  3. প্রাকৃতিক ভাষা: এই ধরনের কবিতা সাধারণত কথ্য ভাষায় লেখা হয়, যা পাঠকদের জন্য সহজবোধ্য এবং উপলব্ধিযোগ্য।
  4. চিত্রকল্পের ব্যবহার: ওপেন ভার্সে চিত্রকল্পের ব্যাপক ব্যবহার দেখা যায়। কবিরা বিভিন্ন চিত্র এবং দৃশ্য তুলে ধরতে সক্ষম হন।
  5. আবেগ ও অভিজ্ঞতার গভীরতা: ওপেন ভার্স কবিকে তার অনুভূতি ও অভিজ্ঞতাকে গভীরভাবে প্রকাশ করার সুযোগ দেয়।

ওপেন ভার্স কবিতা একটি আধুনিক সাহিত্যকর্ম, যা কবির কল্পনাশক্তি এবং অভিব্যক্তির জন্য ব্যাপক সুযোগ প্রদান করে। এটি একটি সৃজনশীল মুক্তিপথ, যেখানে কবি তাদের চিন্তাভাবনাকে সীমাহীনভাবে প্রকাশ করতে পারেন। এই ধরনের কবিতা পাঠকদের জন্য গভীর আবেগ এবং অভিজ্ঞতার অনুভূতি তৈরি করে।

অন্তমিল কবিতা

অন্তমিল কবিতা এমন একটি কবিতা যেখানে শেষ শব্দের প্রতিটি পংক্তির অন্তে বা শেষ অংশে শব্দের মিল থাকে। এটি বাংলা কবিতায় একটি জনপ্রিয় শৈলী। অন্তমিলের মাধ্যমে কবিরা শব্দের সুরেলা রূপায়ণ তৈরি করেন, যা কবিতাটিকে আরও আকর্ষণীয় এবং স্মরণীয় করে তোলে।

অন্তমিল কবিতার বৈশিষ্ট্য

  1. ব্দের মিল: কবিতার প্রতিটি পংক্তির শেষে শব্দগুলোর মধ্যে মিল থাকতে হবে। এটি সুর এবং ছন্দ তৈরি করে।
  2. ছন্দ: অন্তমিল কবিতায় সাধারণত একটি নির্দিষ্ট ছন্দ বা মাত্রা থাকে, যা কবিতাটির গতি এবং সুরকে প্রভাবিত করে।
  3. অভিব্যক্তি: এই ধরনের কবিতা প্রায়শই গভীর অনুভূতি, চিন্তা, এবং চিত্রকল্পের প্রকাশ ঘটায়।

অন্তমিল কবিতার ছন্দ এবং মাত্রা বিভিন্ন হতে পারে, তবে সাধারণত কবিরা ৮-১০ বা ১২ মাত্রার ছন্দ ব্যবহার করেন। এই কবিতায় সাধারণত:

  • ছন্দ: সাধারণত স্বরবৃত্ত বা দোহার ধরনের ছন্দ ব্যবহার করা হয়।
  • মাত্রা: প্রতি লাইনে ৮ বা ১২ মাত্রা সাধারণ।

অন্তমিল কবিতা বাংলা সাহিত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এটি কবিদের তাদের অনুভূতি, চিন্তা ও আবেগকে সুরেলা ও সংগীতময়ভাবে প্রকাশ করার একটি মাধ্যম। এই কবিতাগুলি পাঠকদের জন্য একটি বিশেষ অভিজ্ঞতা তৈরি করে, যা তাদের মনে গভীর প্রভাব ফেলে।

Leave a comment

Trending